এক সুদূর ও পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধার অভাবপূর্ণ গ্রামে বীনাপাণি মহন্ত নানান কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছিলেন। তার চারপাশে প্রয়োজনীয় সমর্থন এবং সুযোগের অভাব থাকার দরুণ, তিনি নানারূপ বাধার সম্মুখীন হন যা তার সহনশীলতা এবং সংকল্পের অগ্নিপরীক্ষা নিয়েছে। এহেন আর্থিক এবং সামাজিক প্রত্যাশার বিভিন্ন সমস্যার উপস্থিতি, যা ব্যক্তিকে সহজেই নিরুৎসাহিত করতে সক্ষম, তা সত্ত্বেও বীনাপাণি দেবী কিন্তু নিজের লক্ষ্যে অটল থেকে এগিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন এবং প্রতিকূলতার মধ্যে অসাধারণ শক্তি প্রদর্শন করেন।
বীনাপাণি মহন্ত ওড়িষ্যার কেন্দুঝর জেলার চম্পুয়া ব্লকের একটি কৃষক পরিবারের মেয়ে। তার বাবা-মা তাকে উচ্চমাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত পড়াশোনায় সমর্থন করলেও যখন সে পরীক্ষায় বেশ কিছু সমস্যার মুখোমুখি হয়, তখন তাদের দৃষ্টিভঙ্গির আমূল পরিবর্তন ঘটে।বীনাপাণির লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়ার পরিবর্তে, তারা তাকে শিক্ষাজীবন ত্যাগ করে বিয়ের জন্য চাপ দিতে শুরু করেন।
বিয়ের পর বীনাপাণি দেবী ওই জেলারই জোড়া ব্লকের অন্তর্গত এক প্রত্যন্ত গ্রাম চর্মালদায় চলে আসেন। এই পুরো এলাকাটি অসংখ্য খনি ও পাথর ভাঙার কারখানা দ্বারা বেষ্টিত হওয়ার পাশাপাশি খারাপ রাস্তাঘাট, নিম্নমানের ইন্টারনেট পরিষেবা সহ নানা প্রকার পরিকাঠামোগত সমস্যায় পূর্ণ। এই অঞ্চলে উন্নয়নের অত্যন্ত অভাব থাকার পাশাপাশি অধিকাংশ বাসিন্দা অনিশ্চিত কর্মসংস্থানের মুখোমুখি, কারণ তাদের কর্মসংস্থান পুরোপুরিভাবে নির্ভরশীল কারখানা ও খনির প্রয়োজনীয়তার ওপর এবং প্রয়োজন ফুরালেই প্রায়ই তারা কাজ হারান।
প্রথমে বীনাপাণি দেবী খুবই ঘরোয়া স্বভাবের ছিলেন এবং সমাজের সেইসব নিয়ম মেনে চলতেন যেখানে একজন নারীর স্থান শুধুমাত্র ঘরেই এবং সেইসঙ্গে এও বিশ্বাস করতেন যে বাইরে কাজ করা নারীদের পক্ষে উপযুক্ত নয়। তবে, তার প্রথম সন্তানের জন্মের পর সবকিছু বদলে যায়, যখন তার স্বামী আকস্মিকভাবে মুখের ক্যান্সার এবং কিডনির পাথরের রোগে আক্রান্ত হন। কাজ করতে অসমর্থ হওয়ায় তাকে কারখানা থেকে বরখাস্ত করা হয়, যা তাদের পরিবারকে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ঠেলে দেয়। এই অনিশ্চয়তার মুখোমুখি হয়ে, বীনাপাণি সামাজিক রক্ষনশীলতাকে অগ্রাহ্য করে তার পরিবারের জন্য একটি নতুন ভবিষ্যত তৈরি করার সংকল্প করেন।
বীনাপাণিকে সন্তান প্রতিপালনের পাশাপাশি স্বামীর চিকিৎসার দায়িত্বভারও গ্রহণ করতে হয়। খনি এলাকায় একটি ভালো বেতনের চাকরি পাওয়া কঠিন হওয়ার দরুন কিন্তু বীনাপাণি শ্রমিকের কাজ করতে বাধ্য হন। দ্বাদশ পরীক্ষায় অকৃতকার্য হওয়ার সার্টিফিকেট থাকা সত্ত্বেও তিনি স্পষ্টতই বুঝতে পেরেছিলেন যে তার বিকল্প খুবই সীমিত। শ্রমিকের আয় দিয়ে তার পরিবার প্রতিপালন সম্ভবপর না হওয়ার কারণে তাই তিনি বাড়ি থেকে প্রায় ৬ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত একটি এনজিও দ্বারা প্রদত্ত বিনামূল্যের সেলাই কোর্সে অংশ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। দূরত্বকে অতিক্রম করে তিনি ক্লাসে যোগ দেন এবং ভালোভাবে কাজ করেন, যা তাকে এমন কিছু কাজের সুযোগ প্রদান করে যা তার স্বামীর ওষুধ কেনায় বিশেষরূপে সহায়ক হয়।
এই এনজিও টির মাধ্যমে তিনি এস্পায়ার সম্পর্কে জানতে পারেন এবং একটি গ্রীষ্মকালীন শিক্ষিকার পদে আবেদন করেন। স্কুলটি তার বাড়ি থেকে ৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত ছিল এবং সেখানে যেতে হলে প্রতিদিন তাকে ট্রাকের চলাচলপ্রবণ একটি জঙ্গলপথ পার হতে হতো। বিশদে চিন্তাভাবনার পরে, তিনি এই শিক্ষিকার পদ গ্রহণ করেন যেকারণে তাকে নিজের ৩ বছরের সন্তানকে অসুস্থ স্বামীর কাছে রেখে প্রতিদিন ১০ কিলোমিটার পায়ে হেঁটে কর্মস্থলে যাতায়াত করতে হতো। তবুও, শ্রেণিকক্ষে তার কর্মদক্ষতা অভিভাবক ও শিক্ষকদের উভয়ের কাছ থেকে সমানভাবে ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া লাভ করে এবং ফলাফলস্বরুপঃ এস্পায়ারের কাছে তাকে স্থায়ী সহকারী শিক্ষক হিসেবে বিবেচনার অনুরোধ জানানো হয়।
তবে, তার জন্য বীনাপাণির প্রথমে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া প্রয়োজনীয় ছিল । সম্প্রদায়ের অবিচ্ছিন্ন সমর্থনে তিনি পুনরায় পরীক্ষা দেন এবং ভালো নম্বর অর্জন করেন, যা তাকে পুনরায় আবেদন করতে এবং এস্পায়ারের একজন এলইপি শিক্ষক হিসেবে নির্বাচিত হতে সহায়তা করে।
বীনাপাণি বিভিন্ন দায়িত্ব সামলাতেন, যার মধ্যে ছিল গৃহস্থালি কাজ, কৃষিকাজ, স্বামীর যত্ন এবং সন্তানের জন্য রান্না করার মত সমস্ত কাজের পাশাপাশি ১০ কিলোমিটার পায়ে হেঁটে বিদ্যালয়ে নিত্য যাতায়াত। যখন তাকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল কীভাবে তিনি এতকাজ একসঙ্গে একা পরিচালনা করছেন, তখন তিনি বলেছিলেন, “মহাশয়া, আমিও তো মানুষ। আমারও বিশ্রামের প্রয়োজন হতো, কিন্তু আমার এই দায়িত্বগুলোই আমাকে এগিয়ে যেতে প্রেরণা দিত। অনেক সময় আমি আমার দুপুরের খাবার নিয়ে যেতে ভুলে যেতাম এবং সারাদিন না খেয়ে কাটাতাম। একবার তো ক্ষুধার কারণে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলাম, তখন জনসম্প্রদায়ের অভিভাবকরা আমাকে সহানুভূতির সঙ্গে তাদের বাড়ি নিয়ে যান এবং খাবার দেন। সেই অভিজ্ঞতা সম্প্রদায়ের সঙ্গে আমার সম্পর্ককে আরও গভীর করেছে, যা আমার জন্য দৈনন্দিন প্রতিগুলতাগুলির মোকাবিলা করা আরও সহজ করে দিয়েছে।”
বীনাপাণির এলইপি এলাকার সকল পরিবারই তফসিলি উপজাতিভুক্ত (এসটি) এবং সেখানে শিক্ষার ওপর পর্যাপ্ত গুরুত্ব আরোপিত হতো না। ফলস্বরুপঃ অনেক শিশুই নিয়মিতভাবে বিদ্যালয়ে অনুপস্থিত থাকত। এলইপি শিক্ষকতার সঙ্গে যুক্ত হওয়ার পর, বীনাপাণি প্রতিদিন গৃহ পরিদর্শন শুরু করেন এবং জনসম্প্রদায়ের সঙ্গে নিয়মিত সভা সংগঠিত করেন, যার ফলে মাত্র এক মাসের মধ্যে বিদ্যালয়ে উপস্থিতির হার ৪৫% থেকে ৯৪%-এ উন্নীত হয়। শিক্ষাকে শিশুদের নিকট আকর্ষণীয় করার লক্ষ্যে বীনাপাণি এস্পায়ারের প্রশিক্ষণের সহায়তায় পঠনপাঠনে আকর্ষণীয় শিক্ষণ-শিক্ষাদান উপকরণ (TLMs) ব্যবহার শুরু করেন।
কোভিড-১৯ মহামারির সময়, যখন শিক্ষাকে সেভাবে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়নি, বীনাপাণি প্রতিদিন ১০ কিলোমিটার পায়ে হেঁটে এস্পায়ারের “ফাউন্ডেশনাল লিটারেসি এন্ড নিউমেরাসি” এবং “লকডাউন লার্নিং প্রোগ্রাম” এর মাধ্যমে শিশুদের পঠন-পাঠন চালিয়ে যান । তার কাছে শিশুশিক্ষার এই মহান দায়িত্ব পালন সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ছিল এবং তিনি নিষ্ঠার সঙ্গে তার এই কাজ সম্পাদন করতেন। গ্রামের প্রতিটি শিশু তার এহেন উদ্যমের সাথে পরিচিত। তিনি “ভিলেজ এডুকেশন রেজিস্টার” (ভিইআর) এর ব্যবহারের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি অতি সাবধানে নিরীক্ষণ করতেন। প্রতি মঙ্গলবার তিনি স্কুলে ভর্তি হওয়া শিশুদের অবস্থা পর্যবেক্ষনের জন্য বাড়ি বাড়ি পরিদর্শন করতেন এবং প্রতি বৃহস্পতিবার স্কুলে উপস্থিতির হিসাব নিতেন, যাতে অনুপস্থিতদের চিহ্নিত করা যায়। পাশাপাশি, প্রতি শনিবার তিনি শিক্ষণ পদ্ধতির উন্নতির জন্য হিতাধিকারীদের সঙ্গে সভার আয়োজন করতেন।
যেকোন পরিস্থিতিতে বীনাপাণির ঠোঁটে সর্বক্ষণের স্মিত হাসি বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয়। নিত্য-নৈমিত্তিক দায়িত্ব পালনের পর তিনি বিদ্যালয়ে যান এবং সক্রিয়ভাবে শিক্ষাদানে যুক্ত থাকেন। এস্পায়ারের সহায়তায় বীনাপাণি তার স্নাতক শিক্ষা সম্পন্ন করেছেন এবং বর্তমানে ‘ফাউন্ডেশনাল লিটারেসি এন্ড নিউমেরাসি’ (এফএলএন) কর্মসূচির অংশ। বীনাপাণির জীবন নিজের মেয়েকে দৃঢ় মনোভাবাপন্ন এবং জীবনের প্রতিকূল পরিস্থিতির মুখোমুখি হওয়ার ক্ষমতাসম্পন্ন করে তোলার জন্য নিবেদিত।
বীনাপাণির ভাষায়, “জীবন একটি যাত্রামাত্র, যেখানে বাধাবিপত্তি আসবেই; এবং আমাদের সমস্ত অভিজ্ঞতা ও প্রতিটি মানুষের কাছ থেকে শেখা উচিত। শিক্ষক হওয়ার আগে আমি শ্রমিকের ও গৃহস্থালির কাজ করতাম। কোনো কাজই তুচ্ছ নয়; প্রতিটি কাজই সমান উদ্যম ও নিষ্ঠার দাবি রাখে। আজ আমি যেখানে আছি, তা আমার ধৈর্য ও সহনশীলতার জন্যই সম্ভব হয়েছে। এস্পায়ার আমাকে নিজের গ্রামে এক নতুন পরিচয় খুঁজে পেতে সাহায্য করেছে।”
এস্পায়ার বীনাপাণি দেবীর অবদানের প্রতি বিশেষরূপে কৃতজ্ঞ কারণ তিনি শুধুমাত্র শিক্ষিকাই নন, সেইসঙ্গে অনুপ্রেরণার একজন মূর্ত প্রতীক। বর্তমানে গাড়ি কেনার সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও তিনি প্রতিদিন ১০ কিলোমিটার পায়ে হেঁটে কর্মক্ষেত্রে যাতায়াতকেই শ্রেয় মনে করেন, যা তার কাজ ও জনসম্প্রদায়ের প্রতি অটল নিষ্ঠার প্রতিফলন। তার কর্মনিষ্ঠা ও সহনশীলতা আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে একজন ব্যক্তি কীভাবে সমস্ত বিদ্যমান প্রতিকূলতা অতিক্রম করে অন্যদের উন্নীত করার এক মহান ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেন।