উড়িষ্যার কেওঁঝার জেলায় বহু আদিবাসী সম্প্রদায় বাস, যাদের মধ্যে একটি হল ‘হো’ সম্প্রদায়। এই সম্প্রদায়ের একটি বৃহত্তর অংশ এখনও বনবাসী। জনসংখ্যার অর্ধেকেরও বেশি মানুষ অর্থনৈতিক আয়ের জন্য কৃষিকাজকে গ্রহণ করেছে, তবে এখনও এক- তৃতীয়াংশ ভূমিহীন কৃষি শ্রমিক হিসেবে কাজ করে। কিছু মানুষ ব্যতিরেকে বৃহৎ সংখ্যক মানুষ দেশের বড় শহরগুলিতে ঠিকা শ্রমিক হিসেবে কাজ করছে এবং তাদের বাহিত রক্ত-ঘামের বিনিময়ে শহরগুলির নিরন্তন শ্রীবৃদ্ধি ঘটে চলেছে।
১৪ বছর বয়সী রাজেশ এবং ১০ বছর বয়সী সোনু (বদলানো নাম) দুই ভাই ‘হো’ আদিবাসী সম্প্রদায়ের দুই কিশোর। তাদের গ্রাম ‘রায়ঘাটি’, কেওঁঝার জেলার হাটাডিহি ব্লক সদর থেকে অনেক দূরে অবস্থিত। ‘রায়ঘাটি’কে ঘন বনাঞ্চল থেকে আলাদা করে দেখা অত্যন্ত কঠিন। রাজেশ এবং সোনু তাদের মা-বাবার সঙ্গে সুখী ছিল। তাদের কাছে আয়ের জন্য কোনো কৃষিজমি ছিল না। তবুও পরিবারটি মা-বাবার দৈনিক মজুরি বা বনজ পণ্য বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করত।
এই অঞ্চলে রোগের কারণে মৃত্যু একটি সাধারণ ঘটনা এবং তার চেয়েও সাধারণ বিষয় হল, তার দায়ভারও সেই’মানুষগুলোর ওপরই চাপানো হয়। যখনই এই ‘উন্নত’ সমাজকে তাদের বন, বনজ সম্পদ বা সেখানে বসবাসকারী মানুষের প্রয়োজন হয়, তখন তারা খুব সহজেই সেখানে পৌঁছে যায়। কিন্তু যখন এই আদিবাসীদের মৌলিক স্বাস্থ্যসেবা বা অন্যান্য সুবিধার প্রয়োজন হয়, তখন সেই সুবিধা পৌঁছতে বছরের পর বছর কেটে যায়। চিকিৎসার অভাবে ‘লেবোগা’ এবং ‘সিংরাই’ (রাজেশ ও সোনুর মা-বাবা) মারা যান। সেই সময়ে রাজেশ ও সোনুর বয়স ছিল যথাক্রমে ৪ ও ৬ বছর। এই পরিস্থিতিতে তারা তাদের মামা (জোম্বেই) এর কাছে চলে আসে। জোম্বেইয়েরও আর্থিক অবস্থা ভালো ছিল না। তিনি নিয়মিত অসুস্থ থাকায় কোনো কাজ করতে পারতেন না। এমন অবস্থায় শিশুদের পড়াশোনা তো দূরের কথা, তাদের আহারের সমস্যাও বাড়তে থাকে। কিছুদিন কোনোভাবে চলেছিল, কিন্তু তারপর রাজেশ ও সোনু স্থানীয় এক ঠিকাদারের কাছে কাজ করতে যেতে বাধ্য হয়। এখন তারা স্কুলে যাওয়ার বদলে ঠিকাদারের জেসিবি মেশিন, ট্র্যাক্টর পরিষ্কার করত এবং তার ছাগল চরাত। এর বিনিময়ে তারা দিনে দু’বেলা খাবার, সামান্য টাকা এবং ভবিষ্যতে ড্রাইভার হওয়ার প্রতিশ্রুতি পেয়েছিল। রাজেশ ও সোনুর মতোই প্রায় ৩ কোটি শিশু রয়েছে, যারা হয় অনাথ নতুবা অন্যান্য কারণে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। এমন পরিস্থিতি থেকে আসা শিশুদের লেখাপড়া সবার আগে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
শিবু হেমব্রম (জিপিসিএম, এস্পায়ার) রাজেশ ও সোনুর গ্রামের এবং সম্প্রদায়েরই একজন সদস্য। তিনি এস্পায়ারের সঙ্গে যুক্ত হয়ে তার এলাকাকে শিশুশ্রম মুক্ত করতে এবং প্রতিটি শিশুকে স্কুলে পাঠানোর প্রচেষ্টার সঙ্গে যুক্ত। জুন ২০২২-এ ‘রায়ঘাটি’ এলাকায় এক সমীক্ষার সময় শিবু হেমব্রম এই দুই শিশুকে ঠিকাদারের কাছে শ্রমদানরত অবস্থায় প্রত্যক্ষ করেন। শিবু এরপর শিশুদের মামা ‘জোম্বেই হো’-এর সঙ্গে দেখা করেন এবং তাকে শিশুদের পুনরায় স্কুলে পাঠানোর ব্যাপারে রাজি করেন। তবে এই কাজটি সম্প্রদায়ের মানুষের সমর্থন ছাড়া সম্ভব ছিল না। এস্পায়ার তাদের কাজের অভিজ্ঞতা থেকে বুঝেছে যে সম্প্রদায়গুলির মধ্যে সদর্থক পরিবর্তন আনার ইচ্ছা এবং সামর্থ্য আছে; তাদের প্রয়োজন শুধুমাত্র একটু সহযোগিতা। সেই সহযোগিতা দিয়ে এস্পায়ার তাদের সঙ্গে মিলিত হয়ে এই পরিবর্তন প্রক্রিয়াকে সহজ করে তোলেয় সদাসচেষ্ট। পাশাপাশি, এটি নিশ্চিত করে যে স্থানীয় কমিটিগুলি তাদের শিক্ষাগত অধিকার এবং অন্যান্য অধিকার সম্পর্কে সচেতন হয়ে সঠিকভাবে গণতন্ত্রে অংশগ্রহণের অনুশীলন করতে পারে।
রাজেশ এবং সোনুর মতো অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতি থেকে আসা শিশুদের জন্য একটি বিশেষ কাঠামোর প্রয়োজন হয়। আরবিসি (রেসিডেন্সিয়াল ব্রিজ কোর্স) তাদের এই কাঠামোগত প্রয়োজন মেটায়। এখানে শিশুদের রেখে, তাদের শিক্ষাগত দূরত্ব পূরণ করে, আবার মূল শিক্ষার ধারায় যুক্ত করা হয়। এটি এমন একটি আবাসিক সুবিধা, যেখানে এই শিশুরা তাদের সব ধরনের সমস্যার থেকে মুক্ত হয়ে তাদের পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারে। এখানে আসা শিশুদের মধ্যে শুধু রাজেশ এবং সোনুর মতো পরিস্থিতি থেকে আসা শিশুরাই নয়, অনেকেই পাচার, নির্যাতন, অবহেলা, হিংসা এবং শিশু শ্রমের শিকার হয়ে আসে।
এই দুই শিশুর জন্য এটি একটি নতুন স্থান ছিল, যেটি তাদের গ্রহণ করতে অনেক কঠিন হচ্ছিল। আরবিসিতে একটি নিয়ন্ত্রিত পরিবেশ বর্তমান, যেখানে খাবার, পড়াশোনা, সকালবেলা ওঠা, স্নান-ধোয়া, শারীরিক ব্যায়াম, খেলা ইত্যাদির জন্য একটি নির্ধারিত সময় থাকে। অনেক সময় এই নিয়ন্ত্রিত পরিবেশ শিশুগুলির কাছে অপছন্দনীয় হতে পারে, বিশেষ করে সেইসব শিশুদের জন্য, যাদের শৈশব গাছপালায় পরিপূর্ণ, খোলা পরিবেশে কাটে। রাজেশ এবং সোনুর ভাষা ছিল ‘হো’, এবং আরবিসির অধিকাংশ শিশু উড়িয়া ভাষায় কথা বলত, যার কারণে তাদের অন্য শিশুদের সাথে সংযোগ স্থাপন করতে আরও সমস্যা হচ্ছিল। মাত্র দুই সপ্তাহ পেরিয়ে ছিল, যে একদিন দুইটি শিশু আরবিসি থেকে পালিয়ে বাড়ি চলে আসে। তাদের মামা জানিয়েছিলেন যে শিশুরা বাড়ি চলে এসেছে। শিবু আবার শিশুদের আরবিসি নিয়ে আসেন।
সেন্টারের ইনচার্জ চক্রধর যোজো বলেন, “এই ধরনের শিশুদের আরবিসি গ্রহণ করতে কিছুটা সময় নেয় এবং যদি ভাষা আলাদা হয়, তবে সবার জন্যই এটি কঠিন হয়ে পড়ে।” আরবিসির শিক্ষকদের নির্বাচনের প্রক্রিয়ায় এসপায়ার বিশেষভাবে খেয়াল রাখে যে, শিক্ষকের একাধিক স্থানীয় ভাষায় দক্ষতা থাকা উচিত, যাতে তারা বিভিন্ন ভাষা থেকে আসা শিশুদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করতে পারে এবং তাদের নিজস্ব ভাষায় শিক্ষা দিতে পারে। চক্রধর বাবু উড়িয়া ছাড়াও হো, সাঁওতালি, হিন্দি এবং কিছুটা তামিলও জানেন। এই বিষয়টি শিশুগুলির জন্য পরিবেশ গ্রহণে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। অনেক সময় এমন শিশুও আসে, যাদের মানসিক অবস্থা অনেক খারাপ থাকে। এমন পরিস্থিতিতে শিশুদের প্রশিক্ষিত কাউন্সেলরের প্রয়োজন হয়। এই ধরনের পরিস্থিতির জন্য এসপায়ার নিমহ্যান্স (NIMHANS)-এর সাথে মিলিতভাবে শিশুদের কাউন্সেলিং করে এবং তাদের শিক্ষকদের প্রশিক্ষিত করার কাজ করে।
রাজেশ এবং সোনু এখানে আসার প্রায় এক বছর হতে চলেছে। তারা এখানে শুধু উড়িয়া ভাষায় কথা বলা শেখেনি, বরং উড়িয়া ভাষায় লেখা-পড়াও শিখেছে। এখন রাজেশ এবং সোনুকে শিক্ষার মূল ধারায় অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে। তাদের ‘ওঙ্কার সেবাশ্রম’ আবাসিক স্কুলে যথাক্রমে ৬ এবং ৩ শ্রেণিতে ভর্তি করা হয়েছে। এখানে থেকে যাওয়ার বিষয়ে তাদের প্রশ্ন করা হলে, তারা বলে, “আমি এখানেই থাকতে চাই।” লজ্জায় তারা আরও বলে, “আমার সমস্ত বন্ধু এখানেই আছে, তারা সবাই চলে যাবে।” শিক্ষক সম্পর্কে প্রশ্ন করলে সোনু বলে, “সে তার মতো একজন শিক্ষক হতে চায়।” চক্রধরজি জানান, “সোনু পড়াশোনায় অনেক তুখোড় এবং রাজেশ খেলাধুলায় খুব ভালো।” রাজেশকে প্রশ্ন করা হলে, সে বলে, “সে বড় হয়ে ফুটবল খেলোয়াড় হতে চায়।” রাজেশ ভয় পায় যে, এখানে থেকে যাওয়ার পর তার সমস্ত বন্ধুদের হারিয়ে যাবে, তাহলে সে কার সঙ্গে ফুটবল খেলবে?
আরবিসিতে আসা শিশুরা অত্যন্ত জটিল পরিস্থিতি থেকে আসে, যেখানে তারা খাদ্য থেকে শুরু করে শারীরিক এবং মানসিকভাবে প্রতিটি ক্ষেত্রে নিরাপত্তাহীন থাকে। আরবিসির নিরাপদ পরিবেশে কিছু সময় থাকার পর, যখন এই শিশুগুলি আবার মূলধারায় ফিরে আসে, তখন তারা আবারও নিজেদের নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে শুরু করে। অনেক সময় তাদের মনে হয়, তারা আবার কি সেই একই পরিস্থিতিতে ফিরে যাচ্ছে, যেখান থেকে তারা বেরিয়ে এসেছিল? চক্রধর জি বলেন, “এখান থেকে যাওয়ার পরও আমরা আমাদের শিশুদের উপর নজর রাখি, তাদের ধারাবাহিক পর্যবেক্ষন করি যেন তারা আবার স্কুলের বাইরে না চলে যায়।” এই পর্যবেক্ষনের কাজ এস্পায়ার কর্মীবৃন্দ এবং সেই সম্প্রদায়ের সাথে মিলিতভাবে করা হয়। বর্তমানে ৪৭টি আরবিসি রয়েছে, যেখানে মোট ১০,৮৫৬ জন শিশুকে ভর্তি করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত ৬,৮০৫ জন শিশুকে শিক্ষার মূল ধারায় যুক্ত করা হয়েছে। ২৯৩ জন শিশুর দশম শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছে এবং ১৪৭ জন শিশুর হাই স্কুল পরীক্ষা পাস করেছে। আমাদের আশা, রাজেশ এবং সোনুও একদিন হাই স্কুলের পরীক্ষা উত্তীর্ণ করে কলেজে ভর্তি হবে।
রাজেশ এবং সোনুর মতো আরও হাজার হাজার শিশু রয়েছে, যাদের আরবিসির মতো একটি কাঠামোর প্রয়োজন। যেখানে তারা কোনো ধরনের ভয় অথবা অভাব ছাড়াই তাদের স্বপ্ন বুনতে পারে এবং একটি শক্তিশালী ও সচেতন নাগরিকের মতো তাদের সামাজিক দায়িত্ব পালনের যোগ্য হয়ে উঠতে পারে।