আমার নাম মায়াবতী নেটি। আমার পিতা শ্রী লক্ষ্মণ সিং এবং মা শ্রীমতি জানবাই। মোট সাতজন সদস্য নিয়ে আমাদের পরিবার। আমার পিতামহ ও পিতামহী পৃথক বসবাস করেন এবং আমি তাদের সঙ্গেই থাকি। আমার বাবার মতে ঠাকুরদা-ঠাকুমার সহায়তার জন্য তাদের সঙ্গে কারো থাকা উচিত, তাই আমি তাঁদের সঙ্গে থাকতে শুরু করি। যদিও তখন আমার বয়স খুবই কম ছিল। যখন আমি সেই দিনগুলোর স্মৃতিচারণ করি, তখন মনে হয় অত ছোট বয়সে এত দায়িত্বের বোঝা কেন আমার ওপর চাপানো হয়েছিল? যদিও আমি একমাত্র মেয়ে ছিলাম না যার ওপর এমন দায়িত্ব চাপানো হয়েছিল। আমাদের সমাজে বেশিরভাগ মেয়েদেরই এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয় যখন বাল্যবস্থায় তাদের গৃহের সমস্ত দায়িত্ব পালন করতে হয়। আমি আমাদের গ্রাম মুকুয়ার প্রাথমিক বিদ্যালয়ে লেখাপড়ার পাশাপাশি ঘরের সমস্ত কাজও করতাম, যেমন— রান্না করা, জল নিয়ে আসা, ঝাঁট দেওয়া, বাসন মাজা ইত্যাদি। ঘরের কাজের পাশাপাশি আমাদের বাইরের কাজও করতে হতো। বাড়ির বাগানে সবজি চাষ করা এবং সেগুলো বাজারে গিয়ে বিক্রি করা, জঙ্গল থেকে কাঠ আনা এবং বাঁশের কেরিল সংগ্রহ করার মতো নানান কাজ।এই সমস্ত কাজ করার পরে যে সময় বাঁচত, তখন আমি স্কুলে যেতাম। এভাবে কোনোরকমে আমি পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা শেষ করতে পেরেছিলাম।
ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হওয়ার মুহূর্তে ছোট ভাই-বোনদের দেখাশোনার দায়িত্বও আমার কাঁধে এসে পড়ল। মেয়েদের বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের কাজের দায়িত্বও বাড়তে থাকে। তাছাড়া সমাজে তো এমন ধারণাই প্রচলিত রয়েছে যে, ‘মেয়েদের তো ভবিষ্যতে ঘর-পরিবারই সামলাতে হবে! তাহলে বেশি পড়াশোনা করে লাভ কী?’ আমি ভীষণ কান্নাকাটির পরে অনুরোধ করেছিলাম যে আমি পড়াশোনা করতে চাই। আমি দিদির মতো নিরক্ষর থাকতে চাইনি। এই বিষয়ে বাবার সঙ্গে দাদুদিদার মতবিরোধও হয়েছিল, কিন্তু সেই মনোমালিন্যের ফল ভালো হয়। আমাকে লেখাপড়ার জন্য বিনঝরার কন্যা আশ্রমে ভর্তি করা হয়। আমাদের পরিবারের আর্থিক অবস্থা ভালো ছিল না, কিন্তু আমার গভীর অধ্যাবসায়ে মুগ্ধ হয়ে কন্যা আশ্রমের প্রধান শ্রীমতি রীতা যাত্রা মহাশয়া আমার লেখাপড়ার যাবতীয় খরচ বহনের প্রতিশ্রুতি দেন। আমি উচ্চ অংক লাভের সহিত অষ্টম শ্রেণি উত্তীর্ণ হই এবং পরবর্তীতে সিংঘিয়াযর প্রি-ম্যাট্রিক কন্যা আশ্রমে ভর্তি হই। সেখান থেকেও আমি সাম্মানিক অংক লাভ করে পড়াশোনা সম্পূর্ণ করি।
মাধ্যমিক পরবর্তী লেখাপড়ার জন্য প্রতি মাসে ৩৫০ টাকা খরচ হচ্ছিল, যা আমার পরিবারের পক্ষে বহন করা খুবই কঠিন হয়ে পড়েছিল। শেষ পর্যন্ত, আমাকে বাড়ি ফিরে আসতে হয়। আমি আবারও মা-বাবার কাছে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার অনুরোধ করি, কিন্তু তারা বললেন, “এত পড়াশোনা করে কী হবে, যখন শ্বশুরবাড়ি গিয়ে ঝাঁড়-ঝাঁটা আর রান্নাবান্নাই করতে হবে?” সেই সময় আমার মনে হতো যে পিতা-মাতার আমার লেখাপড়ার বিষয়ে বিন্দুমাত্র উৎসাহ নেই। কিন্তু এখন আমি তাদের সমস্যাগুলো তথা তাদের সেকেলে ধারণা ও সীমাবদ্ধতাগুলো বুঝতে পারি। আমাদের সমাজে মেয়েদের ক্ষেত্রে এমন ধারণাই দৃঢ় প্রতিষ্ঠিত এবং আমার মা-বাবার পক্ষে এরূপ ধারণা থেকে মুক্ত হওয়া সহজ ছিল না। আমি মহুয়ার ফুল এবং তেন্দু পাতা জঙ্গল থেকে সংগ্রহ ও বিক্রি করে কোনরকমে সেই টাকা দিয়ে মাধ্যমিক পরবর্তী পড়াশোনা সম্পন্ন করি। এভাবেই আমি দ্বাদশ শ্রেণী উত্তীর্ণ হই। কিন্তু শিক্ষিকা হওয়ার জন্য এটুকু যথেষ্ট ছিল না। আরও লেখাপড়ার জন্য অর্থের প্রয়োজন ছিল কিন্তু বাড়ির আর্থিক অবস্থা তার অনুকূল ছিল না। কারো কাছে সাহায্যের জন্য হাত পাততে আমার কখনো ভালো লাগত না। সেই সময় আমাদের গ্রামে নরেগা (যা এখন মনরেগা নামে পরিচিত) প্রকল্পের কাজ চলছিল। গ্রামের মানুষ আমাকে বললেন, “তুমি এতে মেট (সুপারভাইজার) হিসাবে কাজ করতে পারো।” আমি মেট পদের জন্য আবেদন করি। এই কাজ প্রতিদিন হত না, তবে যখনই কাজ হত, আমি তা করতাম। কিছু সময় যেতে না যেতেই মা-বাবা আমার বিয়ের জন্য উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লেন। তাদের মতে, আমার বিয়ের উপযুক্ত বয়স হয়ে গিয়েছিল।
শিক্ষক হওয়ার আমার স্বপ্ন পূরণের জন্য ডি.এড পাঠ্যক্রম সম্পূর্ণ করা প্রয়োজন ছিল, কিন্তু নরেগার দৈনিক আয়ে তার খরচ চালানো একেবারেই সম্ভব ছিল না। তখন আমার মনে হত, গ্রামের মানুষেরা হয়তো ঠিকই বলে যে মেয়েদের জীবনে রান্না-বাড়ার কাজ ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই। এই গভীর হতাশার সময়েই আমি এস্পায়ার নামক একটি সংস্থার কথা জানতে পারি, যা আমাদের এলাকায় শিশুদের শিক্ষার জন্য কাজ করছিল। এই সংস্থার মাধ্যমে আমি আবার আশার আলো দেখতে পাই। একদিন গ্রামে এস্পায়ার কর্মীবৃন্দ কতৃক একটি সভার আয়োজন করছিলেন যেখানে সরকারি বিদ্যালয়ে শিশুদের পঠন-পাঠন বিষয়ে আলোচনা হয়। সেই সময় আমার মনে হয়— আমি যদি পুরোপুরি এস্পায়ার-এর সঙ্গে যুক্ত হয়ে স্কুলে শিশুদের পড়ানোর কাজ করি! শিক্ষকতাই তো আমার স্বপ্ন! খুব দ্রুত আমি এলইপি (লার্নিং এনহান্সমেন্ট প্রোগ্রাম) শিক্ষিকা পদের জন্য আবেদন করি।
কিছুদিন পরে দুই জায়গাতেই আমার নাম নির্বাচিত হয়—আঙ্গনওয়াড়ির সহায়িকা পদে এবং এলইপি শিক্ষিকার। কিন্তু আমি কিছুতেই সিদ্ধান্ত নিয়ে উঠতে পারছিলাম না যে কোন পদটি নির্বাচন করব! একদিকে ছিল আঙ্গনওয়াড়ির সহায়িকার কাজ,যার ভবিষ্যতে স্থায়ী হওয়ার সম্ভবনা বিদ্যমান, এবং অপরদিকে ছিল শিক্ষকতার পদ, যা ছিল আমার স্বপ্ন। অবশেষে, আমি শিক্ষিকা হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয় এবং ১৫ এপ্রিল ২০২৩-এ আমি মুকুয়া প্রাইমারি স্কুলে তৃতীয় থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত শিশুদের পড়ানো শুরু করি।
এস্পায়ার সবসময় তাদের শিক্ষকদের সময়োপযোগী রাখে। তারা বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণ ও কর্মশালার মাধ্যমে আমাদের শিক্ষাদানের পদ্ধতিকে উন্নত করার চেষ্টা করে এবং যার অংশ সৌভাগ্যক্রমে আমি নিজেও। সেইসঙ্গে, গ্রামে সভা এবং সমাবেশের মাধ্যমে সকলকে শিক্ষার প্রতি দায়িত্বশীল করে তোলার জন্যও নিয়মিত চেষ্টা চলতে থাকে। এর ফলস্বরূপ, এলইপি ক্লাস শুরু হওয়ার আগে যেখানে শিশুদের উপস্থিতির হার ছিল ৫০-৬০ শতাংশ, এখন তা বেড়ে ৯৪-৯৫ শতাংশে পৌঁছেছে।
শিশুদের উপস্থিতি বৃদ্ধির মূল কারণ ছিল পঠনপাঠন পদ্ধতি, রঙিন ও আকর্ষণীয় টিএলএম (টিচিং লার্নিং ম্যাটেরিয়াল)-এর ব্যবহার।এগুলি কীভাবে শিশুদের সঙ্গে কার্যকরভাবে ব্যবহার করতে হয়, তা আমি এস্পায়ার-এর কর্মশালাগুলিতে শিখেছিলাম। বড় বড় ছবিসহ গল্পের বই এবং কার্যকলাপভিত্তিক শিশুদের গান কেবল শিশুদেরই নয়, বড়দেরও আকর্ষণ করত। শিশুদের পড়ানোর এমন পদ্ধতিও থাকতে পারে, তা আমি এস্পায়ার-এ এসেই প্রথম জানতে পারি।
আমি মনঃস্থির করেছিলাম, নিজের লেখাপড়ার সময় যে কষ্টগুলো আমি সহ্য করেছি, তা এই শিশুদের সঙ্গে হতে দেব না। আমি তাদের মনোযোগ দিয়ে পড়াব এবং এটি করতে আমার ভালোও লাগে। এই ভেবে আরও ভালো লাগে, যে স্কুলে আমি একসময় পড়তাম, আজ আমি সেই স্কুলেরই শিক্ষিকা। স্থানীয় মানুষের সঙ্গে আমার সম্পর্ক এখন আরও ভালো হয়েছে।
আমার বাবা-মা থেকে শুরু করে শ্বশুরবাড়ির সবাই এখন আমার কাজ নিয়ে গর্ব অনুভব করেন, যদিও একসময় শ্বশুরবাড়ির লোকেরা আমাকে চাকরি ছেড়ে দেওয়ার কথা বলেছিলেন। অনেক বোঝানোর পর অবশেষে তারা শুধু আমার স্বপ্নকে মেনে নেননি, বরং এখন আমাকে সর্বক্ষন সম্পূর্ণরূপে সহযোগিতা করে থাকেন। বর্তমানে আমি যখন অতীতে ফিরে তাকাই, সবকিছুই কেমন স্বপ্নের মতো মনে হয়। ভাবি, যদি এস্পায়ার-এর সঙ্গে যুক্ত না হতাম, তবে জীবন এত সহজ হত না।
আমার বাবা-মা থেকে শুরু করে শ্বশুরবাড়ির সবাই এখন আমার কাজ নিয়ে গর্ব অনুভব করেন, যদিও একসময় শ্বশুরবাড়ির লোকেরা আমাকে চাকরি ছেড়ে দেওয়ার কথা বলেছিলেন। অনেক বোঝানোর পর অবশেষে তারা শুধু আমার স্বপ্নকে মেনে নেননি, বরং এখন আমাকে সর্বক্ষন সম্পূর্ণরূপে সহযোগিতা করে থাকেন। আজ যখন পেছনে ফিরে তাকাই, তখন সব দুঃখ, সব সমস্যা, সমস্ত প্রতিকূলতাই অতীত মনে হয়।